আমার মাথায় মাঝে মাঝেই নানা অদ্ভুত সব খেয়ালের আবির্ভাব হয়। যেমন কখনও আমার ইচ্ছে জাগে বহু পুরোনো কিছু জিনিস কেনার। আবার কখনও বা খেয়াল হয় নানান দুষ্প্রাপ্য কিছু উদ্ভিদ সংগ্রহ করার। আমার রোজগারের প্রায় বেশিরভাগটাই চলে যায়
আমার এই সব শখ মেটাতে। এটার শুরু আজ থেকে নয়, বছর খানেক আগে থেকেই। তখন আমি সবে কলেজ পাশ করেছি। চাকরীর সন্ধান করছি নানা দিকে। সেই সময় হঠাত শখ হল পুরনো ডায়েরি সংগ্রহ করার। কাগজে একদিন বিজ্ঞাপন দেখলাম, কলেজ
স্ট্রীটের একটা দোকানে পুরোনো ডায়েরি বিক্রি হয়। তারা নাকি নানান জায়গা থেকে অনেক পুরোনো ডায়েরি সংগ্রহ করে বিক্রি করে। একদিন চলে গেলাম কলেজ স্ট্রীট। দোকান টা খুঁজতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেগে গেল। দোকানের সামনে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক
বসে ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
'এখানে কি পুরনো ডায়েরি পাওয়া যায়? কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম।'
লোকটা খানিক অবাক হল বোধ হয়। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
'ডায়েরি কে কিনবে? আপনি?'
'হ্যাঁ'
'একটু অপেক্ষা করুন।'
আমায় অপেক্ষা করতে বলে লোকটা দোকানের ভেতরে চলে গেল। প্রায় পনের মিনিট বাদে একজন লোক এসে আমায় বলল,
'আপনি পুরনো ডায়েরি কিনবেন?'
'হ্যাঁ'
'আসুন আমার সাথে।'
লোকটা পাশের, কাঠের সিঁড়ি টা দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। আমিও তার পেছন পেছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলাম। ওপরে উঠে দেখলাম সেখানে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। ঘরময় বিভিন্ন রঙের ডায়েরির স্তুপ। লোকটা সেই স্তুপের আড়ালে চলে গেল।
কিছু সময় পর একটা নীল ডায়েরি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল লোকটা। এসে বলল,
'মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি কিনবেন?'
মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি! আমি বেশ একটু অবাক হলাম। জানতে চাইলাম,
'কার ডায়েরি?'
'একজন এটা বিক্রি করে গেছে। এটা তার ঠাকুমার ডায়েরি। তিনি নাকি স্বদেশী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন।'
কথা টা শুনে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বললাম,
'এটাই আমি নেব। দাম কত পড়বে?'
'৫০০ টাকা।'
মনে হল এটা পড়ার অভিজ্ঞতা মন্দ হবেনা। তাই এই টাকায় রাজি হয়ে গেলাম। ডায়েরি টা হাতে নিয়েই সারা গায়ে একটা শিহরণ খেলে গেল। খুশী হয়ে দোকানের লোকটা কে ৫০০ টাকা দিয়ে বাড়ি চলে এলাম আর বাড়ি নিয়ে এলাম এক নাম না জানা
মুক্তিযোদ্ধার হাতে লেখা, প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো একটা নীল ডায়েরি। রাতে খাওয়া দাওয়া সারতে প্রায় ১১টা বেজে গেল। ডায়েরি টা নিয়ে অধীর আগ্রহে বিছানায় এসে বসলাম। ডায়েরির প্রথম পাতাতে লাল কালি দিয়ে একটু মোটা হরফে লেখা 'সুধাময়ী রায়
চৌধুরী'। দেখলাম উনি রোজ ডায়েরি লিখতেন না। যেদিন কিছু বিশেষ ঘটনা ঘটত, সেদিন তিনি তা ডায়েরি তে লিখে রাখতেন। ডায়েরি পড়তে পড়তে বুঝলাম তিনি কিশোরী বয়সে পাড়ার একটা স্বদেশী দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরে ওনার বিবাহ হয় শ্যামল
রঞ্জন দত্ত নামক এক দারোগার সাথে। বিয়ের আগে এই সংবাদ সুধাময়ী দেবী জানতেন না। দারোগার সাথে বিয়ে হবার কারণে ওনার দলের লোকেরা আর ওনার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখেনা। তিনি স্বামী কে অনেক বার অনুরোধ করেন, এই কাজ ছেড়ে
দিতে। কিন্তু শ্যামল রঞ্জন সেই অনুরোধ কোনদিন গ্রাহ্য করেননি। পরে সুধাময়ী দেবী জানতে পারেন ওনার দলের কিছু লোক পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। সবাই সন্দেহ করে সুধাময়ী দেবী হয়ত স্বামীর কাছে দলের সব গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে। তিনি মনে
মনে খুব কষ্ট পেলেন এবং প্রতিজ্ঞা করলেন এই অনুমান যে ভুল তা তিনি যে কোন মুল্যে প্রমাণ করবেন। সে সুযোগও একদিন হঠাত এসে গেল তার সামনে। বিয়ের কয়েক বছর পরে সুধাময়ী দেবীর এক পুত্র জন্মায়। তিনি পুত্রের নাম রাখেন তুষার রঞ্জন। তার
স্বপ্ন ছিল তার পুত্র দেশের স্বাধীনতা আনবে, দেশ মাতাকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করবে। পুত্র কে নিয়ে তিনি একদিন মায়ের কাছে গেলেন। সেখানে রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে গেল স্বপ্নিল সেনের সাথে। এনার দলেই সুধাময়ী দেবী একদা যুক্ত ছিলেন।
স্বপ্নিল সেন সুধাময়ী দেবী কে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিল। সুধাময়ী দেবী পেছন থেকে ডাকলেন,
'স্বপ্নিল দা, কেমন আছেন? দলের খবর কি?'
সুধাময়ীর গলা শুনে থমকে দাঁড়াল স্বপ্নিল সেন। এগিয়ে এল সুধাময়ী দেবীর কাছে।
'তুমি দল থেকে বেরিয়ে গেছিলে, তাই নিয়ে আমরা তো কিছু তোমায় বলিনি। কিন্তু দলের লোকেদের ধরিয়ে দিয়ে তুমি কি পেলে সুধা?'
'আপনিও বিশ্বাস করেন আমি দলের লোকেদের ধরিয়ে দিয়েছি?'
'তোমার বিয়ের ঠিক তিন মাসের মধ্যে আমাদের দলের রমেশ, সঞ্জয়, ফারহান আর অসীম ধরা পড়ে। দলের সবাই বিশ্বাস করে এই জন্য তুমিই দায়ী।'
'আপনি এটা বিশ্বাস করতে পারলেন স্বপ্নিল দা? আমি এই দলের জন্য নিজের বাড়ি, নিজের জীবন কোনকিছুই গ্রাহ্য করিনি কোনদিন। তা আর কেউ না জানুক আপনিতো জানতেন। তবুও আপনি এটা মেনে নিলেন?'
'তুমি বাড়ি যাও সুধা। আমাকে এখন যেতে হবে।'
'আমি আপনাদের এই ধারণা যে ভুল তা প্রমাণ করতে চাই। আমায় বলুন কি করতে হবে?'
'পরশু সন্ধ্যায় এস আমার বাড়ি। দলের সবাই থাকবে। তখন কথা হবে। এখন চলি।'
সুধাময়ী দেবী সময় মত স্বপ্নিল সেনের বাড়ি যান। সেখানে তখন দলীয় আলোচনা চলছিল। আচমকা সুধাময়ী দেবী সেখানে প্রবেশ করলেন। ওনাকে ওরকম ভেবে সেখানে দেখে দলের সবাই তো অবাক। ওনাকে সেখানে দেখে আলম চেঁচিয়ে বলল,
'আমাদের দলকে ধরিয়ে দিয়ে তোর সাধ মেটেনি সুধা? এখন এখানে এসেছিস আমাদের খবর নিতে? বাড়ি ফিরে তোর দারোগা স্বামীর কাছে বলবি বলে?'
স্বপ্নিল সেন বলে উঠলেন,
'আঃ আলম, এত উত্তেজিত হোয়োনা। ও এখানে অন্য কারণে এসেছে। ও বলছে ও কিছুই জানতোনা। তাই ও যে এমন কাজ করেনি, তা প্রমাণ করতে ও এখানে এসেছে। এখন আমরা যা বলব ও তাই করতে রাজি। এখন তোমরা বল ওকে কি কাজ দেওয়া যেতে
পারে।'
সন্দীপ বলল,
'তুই পারবি তোর স্বামী কে খুন করতে?'
সন্দীপের এই কথায় ঘরের পরিবেশ মুহূর্তে থমথমে হয়ে গেল। স্বপ্নিল সেন বলল,
'এটা কি বলছিস সন্দীপ? ভেবে বল। এটা ওকে বলা ঠিক নয়। আর আমরা তো এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নই, যে সুধার স্বামীই এর জন্য দায়ী।'
'কিন্তু ওই এলাকাতেই দল ধরা পরেছিল। ও যদি পারে এটা করে দেখাক। নয়তো তোমরাই কিছু বল।'
সবাই চুপ করে রইল। কি বলবে কেউ বুঝতে পারলনা। নিজেদের দলের পুরোনো সদস্যা কে এমন কথা বলাতে সবাই বেশ অবাক। সবাই কে আরও অবাক করে দিয়ে বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন সুধাময়ী দেবী,
'বেশ তোমরা যদি তাই চাও, আমি তাই করব।'
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
এর ঠিক একমাস পর, দুধের সাথে বিশ মিশিয়ে শ্যামল রঞ্জন কে হত্যা করেন সুধাময়ী দেবী। ভারতীয় হবার কারণে ব্রিটিশরা তার হত্যা নিয়ে বেশী মাথা ঘামায়নি। তাই তেমন ভাবে তদন্তও হোলনা। সুধাময়ী দেবী বেঁচে গেলেন। ওনার দলের লোকজন ছাড়া এই
সত্য আর কেউ জানলনা। এই কাজ করেও সুধাময়ী দেবীর মনে কখনও কোন অপরাধ বোধ কাজ করেনি। একজন দেশদ্রোহী কে তার যোগ্য শাস্তি দিতে পেরে মনে মনে তিনি গর্বিত ছিলেন।
ডায়েরি টার প্রায় অর্ধেক টা শেষ করে ফেললাম সেই রাতেই। মহিলার সাহসিকতা আমাকে মুগ্ধ করল। এমন আরও কত জনের কথাই হয়ত চাপা পড়ে গেছে, জানা যায়নি। কিছুদিন নানা কাজে ডায়েরি টা নিয়ে আর বসার সুযোগ পেলামনা। তারপর একদিন
দুপুরে ডায়েরি টা নিয়ে আবার বসলাম। পাতায় পাতায় শব্দ আর শব্দ সুধাময়ী দেবীর মুক্তসম হস্তাক্ষরে লেখা। ওনার জীবনের আশ্চর্য্য সব কাহিনীর ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলাম। আসল চমক ছিল ডায়েরির শেষের কয়েকটি পাতায়। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি
ওইভাবে শেষ হবে এই অসীম সাহসী মহিলার জীবন প্রদীপ।
একদিন সকালে ঘরের পুরোনো আলমারি পরিষ্কার করতে করতে, তিনি একটি পুরনো বাঁধানো লাল খাতা খুঁজে পান। উনি তার আগে কখনও সে খাতা চোখে দেখেননি। কৌতূহল বশত তিনি খাতার পাতা উলটে দেখেন, এবং হাতের লেখা দেখে বুঝতে পারেন সে
খাতা ছিল তার মৃত স্বামী শ্যামল রঞ্জনের। খাতার কিছু পাতা পড়ে তিনি যা বোঝেন তাতে চোখের জল তিনি আটকাতে পারেননা। তিনি উপলব্ধি করেন একসাথে দিন যাপন করলেও একজন মানুষ কে সর্বদা চেনা হয়ে ওঠেনা। খাতা টা পড়ে তিনি বোঝেন শ্যামল
রঞ্জন বিবাহের পূর্বে একটি বিপ্লবী দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই দলের জন্যই তিনি দারোগার চাকরী নেন। যাতে পুলিশের সব কাজকর্ম, গতিবিধি গোপনে দলের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। সেই কারনেই পুলিশের বিশ্বাস অর্জন করতে তিনি মাঝে মধ্যে কিছু
বিপ্লবী কে সাময়িক ভাবে ধরে আনতেন এবং পরে নিজের চেষ্টায় তাদের ছেড়ে দিতেন। আর সেই কারনেই স্বপ্নিল সেনের দলের কিছু ছেলে ধরা পড়েছিল। এতদিন পর আসল সত্যি টা জেনে নিজের ভেতর একটা ভীষণ অপরাধ বোধ জেগে উঠেছিল সুধাময়ী
দেবীর। তিনি ঠিক করেন, রাতেই নিজের জীবন শেষ করে দেবেন।
এখানেই শেষ হয়ে যায় সুধাময়ী রায় চৌধুরীর সেই ডায়েরি। এরপর আর কিছু লেখা নেই দেখে আনুমান করে নেওয়া যায় ডায়েরি তে তিনি যা লিখেছিলেন, শেষমেষ তিনি তাই করেছিলেন। বুকটা কেমন যেন ধড়াস করে উঠল। বুঝিনি চমক তখনও বাকি ছিল।
পাতার ওপর চোখ পরতে আরও একবার অবাক হতে হল। দেখলাম দিনটা ছিল ১২ই মে। ওইদিনই আমার জন্মদিন।
০৯ জানুয়ারী - ২০১২
গল্প/কবিতা:
২০ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪